সূত্র- বিবিসি
প্রাকৃতিকদুর্যোগ, যান্ত্রিক ত্রুটি, মহামারির কারণে যাত্রাপথে অনেক জাহাজেরই সলিল সমাধি হয়েছে সমুদ্রে। শত শত বছরধরে সেগুলো সমুদ্রের গভীরে পড়ে থাকে। লোহার শরীরে সামুদ্রিক জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের নিরাপদআবাসস্থল। তবে গুপ্তধন পাওয়ার আশায় অনেক ডুবুরির সরব বিচরণ জলের নিচে।
সবসময় যে গুপ্তধনই পান, তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু সময় ইতিহাস সৃষ্টি করা অনেক কিছুই খুঁজে পান তারা। যা বরাবরই হতবাককরেছে বিশ্ববাসীকে। সম্প্রতি স্কটিশ উপকূলে পানির নিচে আধখোলা দরজা দিয়ে ডুবুরি যখন একটা জাহাজের ভগ্নাবশেষে গিয়ে পৌঁছলেন, দেখলেন সেখানে এক বিশাল গুপ্তধনঅপেক্ষা করে আছে তার জন্য। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল, এবার সময় হয়েছে তাদের মুক্ত হওয়া।। সেই গুপ্তধন কোনো সোনাদানা, হীরা জহরত নয়, বিয়ার। হাজার হাজার বিয়ারের বোতল।
অনুসন্ধানকারীও ডুবুরি টেকনিশিয়ান স্টিভ হিকম্যান নিজের সঙ্গে করে একটা নেটের ব্যাগ নিয়ে গিয়েছিলেন। জাহাজের ভেতর পড়ে থাকা ও আংশিকভাবে পলিমাটিতেনিমজ্জিত বিয়ারের কাচের বোতলগুলো তুলে আনাই ছিল তার উদ্দেশ্য। প্রথম বোতলটা তুলতেই পলিমাটির ধুলার মেঘে হিকম্যান প্রায় অন্ধ হতে বসেছিলেন। কিন্তু তার কাছে এসব পরিস্থিতি অজানা নয়, তাই নিজেকে মানিয়ে আরো কিছু বোতল সংগ্রহ করার পর তিনি তারদল নিয়ে পানির উপরে উঠে এলেন। এই ধ্বংসাবশেষ ছিলস্কটিশ উপকূলে অন্য এক জাহাজের সঙ্গেসংঘর্ষে ডুবে যাওয়া কার্গো জাহাজ ‘ওয়ালাশিয়া’ এর। গ্লাসগো থেকে যাত্রা শুরু করা জাহাজ ওয়ালাশিয়াতে অসংখ্য কার্গো, টিন ক্লোরাইড নামক কেমিকেলের পাশাপাশি ছিল হাজার হাজার বোতল পানীয়। এগুলোর বেশিরভাগই ঠাণ্ডা পানির মধ্যে সংরক্ষিত ছিল এবং এক শতকেরও বেশিসময় ধরে সমুদ্রের পলিমাটির ভেতরে ডুবে ছিল জাহাজের ধ্বংসাবশেষ হয়ে।১৯৮০ সাল থেকে ওয়ালাশিয়ার ভেতরে নিজের অনুসন্ধান শুরু করেছেন হিকম্যান। এযাবৎ তিনি ওয়ালাশিয়া থেকে উদ্ধার করেছেন হুইস্কি, জিন ও বিয়ারের কয়েকডজন বোতল। কিন্তু এবার সঙ্গী হিসেবে আরো কিছু ডুবুরিকে নিয়ে ওয়ালাশিয়ার ভেতরে যান হিকম্যান এবং খুঁজে পান অস্বাভাবিক কিছু জিনিস। এবারের উদ্ধারকৃত বোতলগুলো তারা ‘ব্রুল্যাব’ নামের একটি গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তারা সান্ডারল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে তিন বোতল বিয়ার থেকে সজীব ইস্ট বের করতে সক্ষম হয়েছেন। এরপর তারা সেই ইস্ট নতুন বিয়ার বানাতে প্রয়োগ করেছেন। আর তাতেই বেরিয়েএসেছে এক আজব তথ্য।ওয়ালাশিয়ার এসব বিয়ারের বোতলে থাকা ইস্ট একটি অস্বাভাবিক প্রকৃতির ইস্ট। এই মুহূর্তে বিজ্ঞানীরাবুঝার চেষ্টা করছেন যে এই হারানোস্ট্রেইনকে আধুনিক পানীয় ঘনীভূতকরণ পদ্ধতিতে কিংবা বিয়ারের স্বাদ ভালো করতে ব্যবহার করা যায় কিনা। এর আগেও ২০১৮সালে তাসমানিয়াতে একই রকম আরেকটি প্রজেক্টে ২২০ বছর পুরনো বিয়ারের বোতল পাওয়া গিয়েছিল। পুরনোজাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে পুরনো বোতল, প্রাচীন পাত্র খোঁজা এবং সেগুলো থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পুরনো স্ট্রেইন অনুসন্ধানের এই কার্যক্রমকে বলাহয় ‘বায়োপ্রসপেক্টিং’। এ ধরনেরঐতিহাসিক ইস্ট দূষণ কমানো থেকে ধরে পারফিউম শিল্পে সুগন্ধি উৎপাদনেও ব্যবহৃত হতে পারে।
১৯৮০সালে যখন স্টিভ হিকম্যান প্রথম ওয়ালাশিয়া থেকে কিছু বিয়ারের বোতল খুঁজে পান, তখন পর্যন্ত বিয়ারগুলোকে পানযোগ্য মনে করা হয়েছিল। সেসময় এটি ছিল ১০০ বছর পুরনো। হিকম্যান ও তার বন্ধুরাবাড়ি ফিরে গ্লাসে বিয়ার ঢাললেন। দেখা গেল এটি আস্তে আস্তে ঘন, কোমল-মসৃণ আকারে গ্লাসে বসে গেল। কিন্তু এর জাদু এখানেইশেষ হয়েছিল।
হিকম্যানজানালেন, ‘তখন এর মধ্যে খুববাজে গন্ধ ছিল। এটা ছিল অনেকটা লবণাক্ত, পচা গন্ধের। আর খেতেও ভালোছিল না।’ আর সেই বোতলগুলোদীর্ঘদিন পর পানির উপরেউঠে আসায় ভেতরের গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হয়ে গ্লাস ফেটে যাওয়ার মত ঘটনাও ঘটেছিলতখন। বর্তমানে বিয়ারগুলোর গন্ধ আরো খারাপ হয়েছে এবং এগুলো খাওয়ার অযোগ্য। তবে এগুলোর ইস্ট থেকে বানানো নতুন বিয়ারের স্বাদ নিয়েছেন হিকম্যানের কিছু সঙ্গী ডুবুরি। তাদেরই একজন, অ্যান্ডি পিলে জানিয়েছেন, নতুন বিয়ারের স্বাদ হয়েছে ৭ দশমিক ৫শতাংশ তেতো।
ব্রুল্যাবএর প্রতিষ্ঠাতা কেইথ থমাস জানান, তারা এই বিয়ারগুলো অত্যন্তসাবধানে ব্যবহার করেছেন। জীবাণুমুক্ত বাতাসভরা বিশেষ ক্যাবিনেটে নিয়ে এগুলোর মুখ খোলা হয়েছে, যাতে বিজ্ঞানীরা বিয়ারের প্যাথোজেন দ্বারা আক্রান্ত না হন।
বিয়ারগুলোরজেনেটিক পরীক্ষায় জানা যায়, ওয়ালাশিয়া বিয়ারে দুই ধরনের ইস্ট আছে। এগুলো হলো- ব্রেটানোমিসেস এবং ডেবারিওমিসেস। এত পুরনো কোনোবিয়ারে ডেবারিওমিসেস পাওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার। বর্তমানে শুধু কিছু বেলজিয়ান বিয়ারে ক্রমাগত গাঁজন এর মাধ্যমে এইউপাদান দেয়া হয়।
তবেথমাস ওয়ালাশিয়া বিয়ার থেকে পাওয়া ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট। তিনি মনে করেন, ১২৬ বছর পুরনো বিয়ার থেকে পাওয়া ইস্ট আধুনিক পানীয় প্রস্তুতকারকদের অনুপ্রাণিত করবে। এসব ইস্টের মধ্যে এক ধরনের ‘ওয়েটহর্স’ বৈশিষ্ট্য আছে যা শুনতে লোভনীয়মনে না হলেও; এরব্যবহার নতুন বিয়ারের মধ্যে প্রাকৃতিক ফ্লেভার এনে দিতে সক্ষম যা বিয়ারকে দিবেঅতুলনীয় ও সবচেয়ে আলাদাএক স্বাদ।
সূত্র- বিবিসি
0 মন্তব্যসমূহ